প্রাবন্ধিক, লেখক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবুক এস ওয়াজেদ আলির সংক্ষিপ্ত জীবন

মননশীল প্রাবন্ধিক, গল্পলেখক ও ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা এবং বাঙালি পন্ডিত মানুষ ছিলেন এস ওয়াজেদ আলি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান ভাবুকের নাম এস ওয়াজেদ আলি। আমাদের দর্শন, পর্যালোচনা ও ভাবুকতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁর মত এমন অনেকের কথাই আমরা জানি না, অনেক মনীষীই আজ বিস্মৃত। মহান চিন্তক এস ওয়াজেদ আলি একজন উদার ও প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন, মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন। মননশীল চেতনা, ইতিহাস ও নীতিজ্ঞান এবং সত্য ও সুন্দরের মহিমায় তাঁর সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর রচনায়-সাহিত্যে এই দুই গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

শেখ ওয়াজেদ আলি ১৮৯০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শণ্ঠীরামপুর মহকুমার বড় তাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শেখ বেলায়েত আলি, তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং শিলং-এ স্থায়িভাবে বসবাস করতেন। ১৮৯৫ সালে বড় তাজপুর গ্রামের পাঠশালায় মেধাবি ওয়াজেদ আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে তিনি শিলং মোখার হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯০৬ সালে স্বর্ণপদক লাভ করে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি আলীগড় কলেজ থেকে ১৯০৮ সালে আইএ এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১০ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১২ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় বিএ ডিগ্রি ও বার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৫ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

এস ওয়াজেদ আলির প্রথম প্রবন্ধ ‘অতীতের বোঝা’ ১৯১৯ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এস ওয়াজেদ আলি ১৯১৯ সালে Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে একটি ইংরেজি জার্নাল এবং ১৯৩২ সালে গুলিস্তাঁ নামে একটি বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯২৫ সালে তাঁর ছোটোগল্প ’রাজা’ ইসলাম দর্শন এ প্রকাশিত হয়। তিনি পরপর দুবার (১৯২৫ ও ১৯২৬) বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে তিনি উক্ত সমিতির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং একই বছর তাঁর ছোটোগল্পগ্রন্থ গুলদস্তা প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি কলকাতা এলবার্ট হলে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা প্রদান উপলক্ষে গঠিত সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি হিসেবে অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন। একই বছর তিনি ‘আসাম মুসলিম ছাত্র সমিতি’-র বার্ষিক সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালের এপ্রিলে তিনি নোয়াখালী মুসলিম ইন্সটিটিউটের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সম্মিলনী’-তে সভাপতি হিসেবে যোগদান করেন।

লেখক হিসেবে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনী রচনায় তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে: প্রবন্ধ জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালী (১৯৪৩), আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ; গল্প গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); উপন্যাস গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০); ভ্রমণকাহিনী পশ্চিম ভারত (১৯৪৮), মোটর যোগে রাঁচী সফর (১৯৪৯) প্রভৃতি।

অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত রচনার ক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের অবদানের মূল্যায়নে তিনি তৎপর ছিলেন। ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী। পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধের মধ্যেও তিনি সরস কবিত্বময় স্টাইল রক্ষা করেছেন। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে আমরা যেন ভুলে না যাই- এই হোক আমার কামনা। প্রাবন্ধিক, গল্প লেখক ও ভ্রমণ কাহিনী রচয়িতা এস ওয়াজেদ আলী বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক আগেই ১০ জুন ১৯৫১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।