সু-নাগরিকত্ব এবং প্রচার মাধ্যম: একটি মানবিক প্রশ্ন

সাম্প্রতিক কালে, গত চার মাসে, করোনা আবহতে পৃথিবীতে মানবিক সহাবস্থানের সংজ্ঞা অনেকটাই বদলে গেছে। অতিমারীর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মানুষের একে অপরের প্রতি সামাজিক এবং মানবিক দায়ভার অনেকটাই বেড়ে গেছে। ভারতবর্ষে অভূতপূর্ব আচমকা করোনা লকডাউন সরকারের কতটা দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে তা সত্যিই প্রশ্নের দাবি রাখে। পর্যাপ্ত পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই লকডাউন ঘোষণার পরে লজ্জাজনক ভাবে কিছু বিকিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো হয়েছে, তার অবাক সাক্ষী আমরা সকলেই। অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে, যখন পৃথিবীর বাকী দেশগুলোর সাথে ভারতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর সম্মুখীন, তখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর মত অমানবিকতার উর্ধ্বে গিয়ে কোনো মানবিক পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই সু-পরিকল্পিত অমানবিকতার প্রচারের আলোয় কি বাস্তবক্ষেত্রের অপর একটি দিক, যেখানে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য করেছে একে অপরকে, সেই দিকটা কি ঢাকা পড়ে যায়? হয়তো না। প্রচারের তীব্র আলো যখন পরিকল্পিত ঘৃণাকে প্রচার করে বিনোদন হিসাবে পৌঁছে দিয়েছে আপামর জনসাধারণের ঘরে, ঠিক তখনই প্রচারের সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে, প্রাণপণ করে সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের বিবেক এখনো বিকিয়ে যায়নি। বহু ছাত্র, শিক্ষক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এবং তার বাইরেও, ব্যক্তিগত পরিসরে, অকাতরে মানুষ মানুষকে সাহায্য করে গেছেন, চলেছে মানবিকতার অসাধারণ বিনিময়।

তেমনই একটি সামাজিক সেবামূলক সংগঠন হল বেস (বেঙ্গলী একাডেমিয়া ফর সোশ্যাল এম্পাওয়ারমেন্ট), যার অজস্র সদস্য নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপেক্ষা করে করোনাকালে মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যেতে দ্বিধা বোধ করেননি একবারও। প্রসঙ্গত, বেসের সাথে নিযুক্ত বেশিরভাগ সমাজকর্মীই বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা অজস্র আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আজ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত। ভাবতে অসহায় লাগে, দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অমানবিক তুলোধনা করে চলেছেন, তখন সেই পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের এই সংগঠনটি, যা বাবাসাহেব আম্বেদকরের দর্শনকে আদর্শ করে চলে, অকাতরে মানুষ কে সাহায্য করেছেন প্রতিদিন। আম্ফান ঝড়ের দাপটে বিধ্বস্ত বিভিন্ন এলাকায় সাহায্য করেছে বেস (বেঙ্গলী একাডেমিয়া ফর সোশ্যাল এম্পাওয়ারমেন্ট), চমৎকার সাংগঠনিক দক্ষতার সাথে। বেসের সাথে নিযুক্ত হাজার হাজার মানুষের সহায়তায় ত্রাণ পৌঁছে গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মগরাহাট, রায়দীঘি হতে মৌসুনী দ্বীপ, উস্থি, পাথর প্রতিমাসহ আরো প্রত্যন্ত স্থানে, যেখানে সরকারী সাহায্য টুকুও পৌঁছতে অনেক দেরী হয়েছে । লকডাউন পরিস্থিতিতে কমিউনিটি কিচেনের মাধ্যমে অজস্র মানুষের প্রাত্যহিক খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, কোলকাতা, হুগলি সহ অনেক জেলায় প্রতিদিন চলেছে কমিউনিটি কিচেন।

বেসের এই লড়াই চলেছে সাংগঠনিক এবং সংঘবদ্ধ প্রক্রিয়াতে, বহু মানুষকে সাথে নিয়ে। বেসের সাংগঠনিক দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে – উচ্চশিক্ষায় নিযুক্ত শিক্ষাকর্মী, ডাক্তারী, ওকালতির মত পেশায় নিযুক্ত মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গেছেন বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা, গড়ে উঠেছে অসাধারণ মানবিক যোগাযোগ, পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ত্রিপল, খাবার, ওষুধ, বাচ্চাদের জন্য খাতা, পেনসিল ও স্টাডি কিট বহু জায়গায়। মানব বন্ধনের এত চমৎকার নিদর্শন স্বাধীনতা উত্তর কালে হয়তো কমই দেখা গেছে এর আগে। সাধারণ মানুষের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে মানব বন্ধনের মাধ্যমে মানুষের সাহায্য করে গেছে বেস। বেসের তৎপর WhatsApp গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ জানিয়েছেন তাদের সমস্যার কথা। সেইমত সাড়া দিয়েছেন বেসের সকল সমাজকর্মী, কেউ বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন, সাথে অন্যরা সেই কাজে অর্থ এবং বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা এবং সহায়তা করে গেছেন। সকলের মিলিত প্রয়াসে গত চার মাসে বেস বিপুল সংখ্যক মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। এই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানববন্ধনের যে চমৎকার নিদর্শন বেস তৈরি করেছে, তা সত্যিই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজের জন্য অনুপ্রেরণার এক নতুন অনুচ্ছেদ রচনা করে। তবে, এই বিপুল কর্মকান্ডের বেশিরভাগই থেকে গেছে প্রচারের আড়ালে।

পূর্বেও অসাংবিধানিক আইন CAA-র প্রতিবাদে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আর সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে বেস। কিন্তু, সে সকল কাজ তারা নীরবেই করে গেছে । প্রসঙ্গত, বেস উচ্চশিক্ষায় নিযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, গবেষক, শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত একটি প্রয়াস। বেসের মূল লক্ষ্য সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনকে মজবুত করা। এবং সমাজে যে সমস্ত আদিবাসী, দলিত এবং মুসলমান এবং অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ক আছে, তাদের সামাজিক ভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে এবং শিক্ষাগত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই উদ্যোগে বেস সমাজের সকল স্তরের মানুষের সাথে গড়ে তুলেছে যোগাযোগ। অনগ্রসর এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষামূলক অগ্রগতিতে বেসের কার্যকরী অক্লান্ত প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয়। অনগ্রসর শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথকে প্রশস্ত করতে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রয়োজনীয় নথি এবং তথ্যাবলী তুলে দেওয়ার কাজ করে চলেছে বেস কয়েক বছর ধরে। এই বছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বহু শিশুর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে স্টাডি কিট, তার মৌলিক অধিকারটুকু।

শুধু আক্ষেপ থেকে যায়, তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে কেবল পরিচালিত এবং পরিকল্পিত ঘৃনার প্রচারই প্রাধান্য পায়। সেখানে মুসলমান সম্প্রদায়কে কেবল অসচেতন নাগরিক হিসাবেই তুলে ধরা হয়। ফলত, বেস (বেঙ্গলী একাডেমিয়া ফর সোশ্যাল এম্পাওয়ারমেন্ট)- এর মত সংগঠন, যারা অনগ্রসর দলিত, মুসলমান এবং আদিবাসীদের জন্য সামাজিক ন্যায়ের যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নীরবে, তা অনেকটাই প্রচারের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের এই শিক্ষিত, সংঘবদ্ধ, সুষ্ঠু কর্মপ্রয়াসে বহু ভালো মানুষ যুক্ত আছেন বলেই কোন প্রকার অসাধু ক্রিয়াকলাপ প্রাধান্য পায় না। প্রচারের আলোয় নিজেদের উপস্থাপন করা বেসের উদ্দেশ্য নয়। বেসের উদ্দেশ্য নিরলসভাবে সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনকে প্রশস্ত করা। আর এহেন কর্মপ্রচেষ্টা এক না একদিন ঠিক প্রকাশ পেয়ে যায়। দায়িত্বশীল নাগরিক সংস্থা হিসাবে বেস যে বিপুল কর্মভার চালিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই তা একদিন আপামর জনমানবের কাছে দায়িত্বশীল নাগরিক কর্তব্যের এক নতুন বৃত্তান্ত তুলে ধরবে, এই আশাই রাখা যায়।

Jahira Hossain has written this and opinion is her personal.